মনেরে বুঝাবো কত যে পথেতে মরন ফাঁসি । লালন গীতির লিরিক্স এবং সারমর্ম
যে পথেতে মরন ফাঁসি
সেই পথে মন সদাই রত ।
যে জলে লবন জন্মায়
সেই জলে লবন গলে যায়
তেমনি আমার মন মনুরায়
মরণ ফাঁসি নিচ্ছে সেত ।
জিভের লোভে মৎস গিয়ে
জালেতে পড়ে ঝাঁপিয়ে
তেমনি আমার মন বেয়ে
একা একা হচ্ছে হত ।
সিরাজ সাঁই দরবেশের বাণী
বুজবি লালন দিনি দিনি
শক্তি হারা ভাবুক যিনি
সেই কি পাবে গুরুর পদ ।
সূচীপত্রঃমনরে বুঝাব কত যে পথেতে মরণ ফাঁসি সেই পথে মন সদাই রত । লালন সাঁইজির এই অফুরন্ত মনের জিজ্ঞাসার কথা দিন দিন মানুষের মনে এক অজানা পিপাসা বাড়িয়ে চলছে। যতই শ্রোতারা এই গান শুনে ততবেশি মুগ্ধ হয়। আজকে আমরা মনরে বুজাব কত, যে পথেতে মরণ ফাঁসি সেই পথে মন সদাই রত ।
এই গানের কথার উপর ভিত্তি করে আলোচনা থাকছে। এক গানের গভীর ভাব নিয়ে আমরা বলার চেষ্টা করবো। অনেকের মনে এই মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজির গানের কথা গুলির ভাব জানার জন্যে ব্যাকুল। তাদের জন্যে আজকে আমাদের এই আর্টিকেল ।
মনেরে বুঝাবো কত যে পথেতে মরন ফাঁসি সেই পথে মন সদাই রত
আমাদের মন সর্বদায় নিচের দিকে ধাবিত হয়। নিচের দিকে মানে যে পথ আমাদের জীবনের জন্যে খুবই দুঃখের হয় কষ্টের হয় এবং বিপদ গামী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেটাই হলো নিচের দিকে ।
আমরা অনেক কষ্ট চেষ্টা করি মনকে কুপথে চালনা না করার জন্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের বার বার সেই কুপথে মনটা চলে যায়। কেন চলে যায় আমরাও নিজেরাও বুজতে পারি না। এখানে সেই কথায় বলা হয়েছে ।
যে জলে লবন জন্মায় সেই জলে লবন গলে যায়
মহাত্মা লালন সাঁইজি এই পংক্তিতে যে কথা বলার চেষ্টা করেছেন যে জলে লবন জন্মায় সেই জলে লবন গলে যায়। লবণের জন্ম হচ্ছে জল বা পানি থেকে আবার সেই লবন পানিতে পারলে আবার গলে গিয়ে একাকার হয়ে যায় ।
কথার সাথে আমাদের বুজতে হবে আমরা মনকে কেন বুজাতে পারছিনা। কেন মনকে বুজতে পারছি না সেই কথার উত্তর দিচ্ছেন। লবণের জন্ম যেমন জল থেকে আমাদের জন্ম হলো কাম থেকে ।
কাম মানে হলো ষড়রিপু প্রধান যিনি তার থেকে। অর্থাৎ মাতৃ রজে আর পিতৃ বীর্যে। মানে ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর মিলনে মানুষের জন্ম হয়। আবার এই কামের চিন্তা করতে করতে আমাদের মৃত্যু হয় ।
মৃত্যু হয় মানে মৃত্যু আমাদের একবার হয় না বার বার হয়। মানুষের মন নিম্নগামী হলে তাকে মৃত্যু বলছে। উর্দ্ধগামী হলে তাকে জীবিত বলছেন। নিম্নগামী মানে হলো মন কুচিন্তায় ডুবে থাকে তৎমধ্যে নির্দয়, নির্মম হয় অন্যের ক্ষতির চিন্তা মাথায় আসে। তখন মানুষ জীবিত থাকলেও মৃত ।
আর জীবিত মানে হলো পরোপকারী, সহশীলতা, ক্ষমা, দয়া ভাব, ভক্তি, প্রেম এবং বিনয়ী হলে মানুষ জীবিত হয়। তাই সেই কামের চিন্তা করলে মানে কুচিন্তা করলে মানুষ মৃত্যু বরন করে ।
এখানে কাম মানে হলো জৈবিক চাহিদা কে বলা হয়েছে যা দেহের মধ্যে বিদ্যমান কিন্তু মনের চিন্তা শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তাই অনিয়ন্ত্রিত মন আমাদের বার বার কুচিন্তার মাধ্যমে মৃত্যু ঘটাচ্ছে ।
জিভের লোভে মৎস গিয়ে জালেতে পড়ে ঝাঁপিয়ে
যা খাওয়ার প্রয়োজন তও খাই আবার যা খাওয়ার প্রয়োজন নেই তাও খাই। লালন সাঁইজি এখানে এই কথায় বুজানোর চেষ্টা করছেন যে মানুষ ও ঠিক মাছের মত লোভের ফাঁদে পরে জীবন নষ্ট করছেন। মায়াজালের ফাঁদে পা দিচ্ছেন ।
সে কারণে অকালে রোগ ব্যাধি আমাদের সমস্যা করছে এমনকি জীবন সংশয় ও হচ্ছে । আহারের অসংযমতার কারণে। এখানে জাল বলতে মায়া জালকে বুজিয়েছেন ।
কারণ মায়া জাল এমন করে বিস্তার করেছেন মহামায়া কেউ এর থেকে বাঁচার উপায় নেই। তাই সংযমতার কথায় এখানে বার বার মহাত্মা জি বলে আসছেন ।
আরও পড়তে পারেনঃ চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে গানের অর্থ কি
শক্তি হারা ভাবুক যিনি সেই কি পাবে গুরুর পদ
শেষের পদে বাউল ফকির মহাত্মা লালন সাঁইজি বলছেন শক্তি হারা ভাবুক যিনি সেই কি পাবে গুরুর পদ। কোন শক্তির কথা বলেছেন। দেহের শক্তি নই মানসিক চিন্তা শক্তির কথা তুলে ধরেছেন ।
এই দুই পদে আমাদের সমস্ত চিন্তা এক জায়গায় গিয়ে আটকে যাচ্ছে। একটি হচ্ছে কাম আর একটি হচ্ছে লোভ । কারণ মনে রাখতে হবে যে যেই চিন্তায় ব্যস্ত সেই সেই ভাব নিয়ে মারা যাবেন । এই চিন্তার মাধ্যমে মানুষ অনেক উপরে উঠার সাহস পাই ।
মানুষের মধ্যে যে কাম রয়েছে বা জৈবিক চাহিদা রয়েছে সেই কামের চিন্তা আমাদের মধ্যে সর্বক্ষণ কিন্তু আমাদের ব্যস্ত রাখছেন। এখানে কামকে শুধু জৈবিক চাহিদা ধরলে হবে না ।
জৈবিক চাহিদা ছাড়াও অনেক ভাবে এই কাম নামক রিপুকে সম্বোধন করে। যেমন কামনা-বাসনা, আশা-আকাঙ্খা, চাওয়া-পাওয়া এই সব হলো কাম এর অন্তর্গত । এই কামের অন্তর্গত সব বিষয়সমূহের চিন্তা একেক বয়সের সাথে একেক রকম চিন্তা পর্যায় ক্রমে আসে ।
এবং এর সাথে লোভের কথা ও রয়েছে। তাহলে আপনি ভেবে দেখুন কিভাবে একজন মানুষ সর্বদা আহার আর কামের ফাঁদে আটকে আছে। যদি এই ফাঁদে সর্বদায় আটকে থাকি তাহলে কিভাবে উচ্চ চিন্তা বা ঈশ্বরের চিন্তায় আমরা মগ্ন থাকব ।
তাই তো বলেছেন এই বিষয়ের বা কাম ও লোভের চিন্তায় মগ্ন থাকলে তারা শক্তিহীন হয়ে পড়ে ধীরে ধীরে। এই শক্তিহীন ব্যক্তি কখনো গুরুর বা ঈশ্বরের চরণ পাই না। কারণ দুর্বল হৃদয়ে কুচিন্তায় মগ্ন হৃদয় কখনো পরমাত্মার দর্শন পাই না ।
মনেরে বুঝাবো কত যে পথেতে মরন ফাঁসি লালন গীতি সারমর্ম
আমাদের মানব জীবনের অনেক কিছুর মধ্যে দিয়ে আমাদের কে জীবন বহন করে নিতে হয় । তবে মনে রাখতে হবে সকল চিন্তার মধ্যে আমাদের জীবন চলে। চিন্তা ছাড়া কোন মানুষ চলতে পারেনা ।
শুধু মানুষ কেন সকল জীব চিন্তা ছাড়া বাঁচে না। মহাত্মা সাঁইজির এই গানে বিশেষ করে আমাদের সারা জীবনের যে চিন্তা শক্তি কাজ করে অদৃশ্য ভাবে, সেই ভাব তুলে ধরেছেন ।
এবং কিভাবে মানুষ এই দুইটি রিপু কাম ও লোভের ফাঁদে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে সেই কথা গানে বর্ণনা দিয়েছেন। যাতে করে আমাদের এই মানব জীবনের ছন্দ পতনের কথা জানতে পারি। এই ক্ষেত্রে আমি ছোট একটা গল্প বলি ।
রামায়ণে রামকে যখন ভাই লক্ষণ জিজ্ঞেস করলেন, দাদা মানুষের সংযম কিভাবে পালন করবে। তখন যুগাবতার ও মর্যদা পুরুষোত্তম ভগবান রাম চন্দ্র ভাই লক্ষণ কে বলছেন। এই প্রশ্নের উওর হনুমান দিবেন।
প্রভূর আদেশ পাওয়া মাত্র ভক্ত হনুমানজী তার এক হাতে জিহবা ধরলেন আরেক হাতে লিঙ্গ বা উপস্ত ধরে দেখিয়ে দিয়েছেন। এই দৃশ্য ভাই লক্ষণ দেখে হেসে হেসে উপহাসের ছলে বললেন তুমি বনের পশু তুমি কিভাবে সংযমের কথা জানবে বা মানুষকে জানাবে ।
এই কথা বলা মাত্র ভগবান রাম বললেন, বনের পশু হনুমান একদম যতোউপযুক্ত শিক্ষায় দিয়েছেন। তখন ভাই লক্ষণ বললেন দাদা আমি কিছুই বুজি নাই আমাকে একটু সবিস্তারে বুজিয়ে বলুন দয়া করে ।
তখন রাম বলছেন, দেখ লক্ষণ যে মানুষের জীবনে এক জিহবা আরেক লিঙ্গ সংযত করতে পারে নাই। তিনি কখনো সংযম পালন করতে পারবে না। সংযমের প্রথম ধাপ হচ্ছে এই জিহবা আর লিঙ্গ। এই দুইটি যার সংযম হয়েছে তিনি জগৎ জয় করতে পেরেছেন ।
মহাত্মা লালন সাঁইজি এখানে এই শিক্ষায় দিয়েছেন এই সমস্ত গানের কথার মধ্যে। আশা করি আর মনের মধ্যে কোন দ্বন্দ নেই বা থাকার কোথাও নেই ।
আমরা চেষ্টা করেছি এই গানের সুন্দর করে সারমর্ম তুলে ধরার। কোন গানের সারমর্ম জেনে গান করলে তখন সেই গান শুনতে ও ভালোলাগে এবং গাইতেও খুব প্রাণ থেকে গাওয়া যায় ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url