জীবে প্রেম করে যেই জন, সেবিছে ঈশ্বর” এই বাণীর তাৎপর্য
সূচীপত্রঃ"জীবে প্রেম করে যেই জন, সেবিছে ঈশ্বর” স্বামী বিবেকানন্দের এই অমর বাণী মনে রেখাপাত করেছে বহু জ্ঞানী, গুণী এবং বিজ্ঞ মানুষদের। আবার সাধারণ মানুষের ভিতরেও সাড়া জাগিয়েছে। কিন্তু অনেক গভীর ভাবনার কথা বলেছেন জীবে প্রেম করে যেই জন, সেবিছে ঈশ্বর এই কথাটির ভিতরে। এই কথার গভীরে লুকিয়ে আছে বাস্তব সত্যতা।
মন্দির মানে শুধু পূজা অর্চনা বন্দনা বা ধূপধুনো দিয়ে ঈশ্বর সেবা নয়। পরন্তু আমাদের শেখায় যে জীবন্ত মানুষের মধ্যে ও ঈশ্বর রয়েছে। অসহায় নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা বা সাহস দান করাকেও ঈশ্বর সেবা বলা হয়।
এই দর্শন আমাদের জীবনের জন্যে এক চিরকালের চলার সাথী। কারণ যুগ বার বার বদলালেও মানুষের দুঃখ কষ্ট কখনো বদলাবে না। তাই এই মন্ত্রের সাহায্যে নিজের মনের উন্নয়ন ঘটানোই হবে আমাদের মূল উদ্দেশ্য। তাহলে চলুন আমরা এই আর্টিকেলে কি কি জানতে পারবো একটু জেনে আসি।
এই আর্টিকেলে থাকছে, স্বামী বিবেকানন্দের মাধ্যমে বিশ্বমঞ্চে জীবে প্রেম করে যেই জন, সেবিছে ঈশ্বর এই ভাবনার প্রসার, কেন “মানবসেবাই প্রকৃত ঈশ্বরসেবা”?দরিদ্র, অসহায় ও অসুস্থের সেবা, কেন তা ঈশ্বরতুল্য? আরো থাকছে, জীবে প্রেম করে যেই জন” আজকের সমাজে এই বাণীর গুরুত্ব ।সব মিলিয়ে এক মানব জীবনের এক বিরাট দর্শনের কথা আমরা আলোচনা করবো । তাই সাথেই থাকবেন আমার প্রিয় পাঠক বন্ধুরা ।
স্বামী বিবেকানন্দের মাধ্যমে বিশ্বমঞ্চে জীবে প্রেম করে যেই জন, সেবিছে ঈশ্বর এই ভাবনার প্রসার
সম্পূর্ণ বানিটির কথা হচ্ছে জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রধান এবং অত্যন্ত প্রিয় ভাজন শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দজী। ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে জাতীয় ধর্মসম্মেলনে ঐতিহাসিক বক্তৃতায় এই বাণীকে তুলে ধরছেন বিশ্ব মানবের কল্যাণের জন্যে।
এই কথাটির মাধ্যমে শুধু ধর্ম নয় মানব সেবার মাধ্যমে ও ঈশ্বর সেবা করা যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মন্দিরের পাথরের দেবতার মধ্যে নয় শুধু প্রকৃত ঈশ্বর হচ্ছে মানুষের মধ্যে। মানুষের সেবায় হলো প্রকৃত ঈশ্বর সেবা।
স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, অসহায়, দরিদ্র ও শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের প্র্রেম ও ভালোবাসা দিয়ে সেবা করাই হচ্ছে প্রকৃত এবং বাস্তব ঈশ্বরকে সেবা করা। এই ভাব এই বাণী তিনি শুধু ভারতেরই সীমাবদ্ধ রাখে নি, ছড়িয়ে দিয়েছেন সারা বিশ্বের দরবারে। যা মানুষ পড়ে এখনো ভাবে আবিষ্ট হয় এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।
তার কথায় কর্মকে প্রাধান্য বেশি দেওয়া হয়েছে যে, ধর্ম হচ্ছে কর্মের মাধ্যমে। যদি আমরা মানুষে প্রকৃতভাবে ভালোবাসতে পারি তার সেবা এবং তার সুখ দুঃখ নিজের মধ্যে ভাগ করে পারি তাহলেই সত্যিকারের ধর্ম পালন করি হতে পারবো।
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেবিছে ঈশ্বর এইভাবনার উপর ভিত্তি করে স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মিশন তৈরী করেছেন যার মূল ভাবনা বা উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মানব সেবার মাধ্যমে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। তাই স্বামী বিবেকানন্দের চোখে "জীবে প্রেম করে যেই জন, সেবিছে ঈশ্বর" একটি মানবিক দর্শন। যে দর্শনে সারা বিশ্ববাসী মানবিক দর্শন শিখেছেন।
কেন “মানবসেবাই প্রকৃত ঈশ্বরসেবা”?
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেবিছে ঈশ্বর এই কথার মধ্যে মানব সেবায় প্রকৃত ঈশ্বরসেবা এই কথাটি বেশিরভাগ ফুটে উঠেছে। একমাত্র মানুষের মধ্যে যে প্রেম স্বামী বিবেকানন্দ তা দেখিয়ে দিয়েছেন। মানুষের ভিতরে যে প্রেম, ভালোবাসা রয়েছে তার ভিতরেই ঈশ্বর রয়েছে। কারণ প্রেম হচ্ছে সর্বউর্ধে। আরো কিছু বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করি চলুন।
ধর্ম কি কেবল উপাসনা? নাকি কিছু বেশি?
ধর্ম কি কেবল উপাসনা নাকি তার চেয়ে আরো কিছু বেশি ? এই প্রশ্ন গুলি আমরা নিজেকে করি না। ঈশ্বর শুধু উপাসনা লয়ে থাকে না ঈশ্বর থাকেন সর্বস্তরের জীবের মধ্যে। ধর্ম শুধু মন্দিরে যাওয়া, উপবাস রাখা এবং প্রার্থনা করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ধর্ম হচ্ছে ধারণ করা।
অর্থাৎ ধর্ম হচ্ছে নিজেকে ধারণ করা। নিজেকে ধারণ করার অর্থ হলো নিজের সততা, দয়া, সহানুভূতি, পরোপকার, সহমর্মিতা এবং প্রেম ও শ্রদ্ধার মাধ্যমে ধরে রাখা। যা শুধু নিজের মধ্যে নয় জীবের মধ্যে রয়েছে। এই বিষয়গুলিকে জীবের মধ্যে দর্শন করা এবং তার সাথে সর্বস্তরের জীবের প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা দান করাই হচ্ছে ঈশ্বর সেবা।
মনে রাখবেন নিজেকে আচার অনুষ্টানের মধ্যে ধার্মিকতা দেখা যায় না। ধার্মিকতার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে জীবের প্রতি দয়া এবং দ্বীন দুঃখী মানুষের সেবা করে হচ্ছে প্ৰকৃত ধর্ম।
উপাসনার বাইরের ধর্মীয় কর্তব্য
সব সময় একটি গন্ডির মধ্যে নিজেকে বন্ধন করলেই আমরা সর্বদা নিয়মের গ্যাড়াকলে পড়ে যাব। উপাসনার বাইরেও অনেক ধর্মীয় কর্তব্য রয়েছে। যেমন তৃষ্ণাতুরকে জল দান করা, অনাহারিকে অন্ন বা খাদ্য দান করা এবং অসুস্থকে সুস্থতা দান করা। এইসমস্ত কাজগুলিও ঈশ্বর সেবার অনন্য এক পন্থা। কারণ মনে রাখতে হবে ঈশ্বর আছেন প্রত্যেক প্রাণীর মধ্যে।
মনুষ্যত্বের ভূমিকা
পরের দুংখ দেখে যে হাসে সে কখনো মানুষ নয় আর ধার্মিক ও নয়। যার ভিতরের মনুষ্যত্ব নেই সে কখনো প্রকৃত ধার্মিক হতে পারেনা। প্রকৃত মনুষ্যত্ব হচ্ছে ধর্মের মূল। তাই অপরের দুঃখে কান্না করা ওপরের সুখে হাসা এইগুলি হচ্ছে প্রকৃত ধার্মিকতা এবং মনুষ্যত্বতা। তাই স্বামী বিবেকানন্দ উচ্চারণ করেছেন প্রাণ ভরে জীবে প্রেম করে যেই জন, সেবিছে ঈশ্বর। কারণ মানবসেবাই হল ঈশ্বরসেবার সর্বোচ্চ রূপ।
দরিদ্র, অসহায় ও অসুস্থের সেবা – কেন তা ঈশ্বরতুল্য?
দরিদ্র ও অসহায় ও অসুস্থের সেবা ঈশ্বরতুল্য বলেছেন এই কারণে যে প্রত্যেক ধর্মীয় গ্রন্থগুলিতে বলেছেন যে, আমি সব মানুষ তথা সব জীবের মধ্যে রয়েছি। অসহায় এবং অসুস্থের মধ্যে ও তাই ঈশ্বর রয়েছেন। সেহেতু দরিদ্র, অসহায় ও অসুস্থের সেবা করার মানে হচ্ছে ঈশ্বরসেবা। চলুন এক্ষেত্রে আমরা কিছু পবিত্র গ্রন্থ ও দর্শন অনুসারে এই ঈশ্বর সেবা নিয়ে কি বলেছেন সেটা দেখে আসি।
পবিত্র গ্রন্থ ও দর্শন অনুসারে দৃষ্টিভঙ্গি
প্রত্যেক ধর্মীয় গ্রন্থে যেমন গীতা, বাইবেল, কোরান এবং ত্রিপিটকেও অসহায় ও অসুস্থ এবং দরিদ্র মানুষের সেবার কথা বলা হয়েছে। গীতায় বলেছেন, অর্জুন তুমি আমার প্রীতির জন্যে জীব সেবা কর। তাতেই আমি অত্যন্ত প্রীত হব।
আবার বাইবেলে প্রভু যীশুর কথা, অসহায় প্রাণী মেষ কে খুব ভালোবাসতেন আবার ভেড়া চরাতেন। তিনি অসহায় পশুদের খুব ভালোবাসতেন। কোরানে ও একই কথা বর্ণিত রয়েছে যে, দান কর জাকাত দাও। অসহায় দরিদ্র মানুষের সহায় হও তাহলে ও আমি খুশি হবে তুমার উপর।
তাছাড়া নবীজির চলার পথে যে বুড়িটা কাঁটা দিত তার কথাতো সবার জানা। এই সব কিছু হচ্ছে স্বয়ং ঈশ্বর সেবা। এই সব কিছুই আমাদের শিক্ষা দেয় যে ঈশ্বর কিংবা প্রভু যে যাই বলুক না কেন, তিনি প্রতিটা জীবের মধ্যে বিরাজমান।
মানবসেবার মাধ্যমে ঈশ্বরের অনুভব
যখন কোন দরিদ্র মানুষকে আহার দেবেন বা কোন অসুস্থ মানুষকে সেবা করবেন অথবা কোন পশুকে যখন তৃষ্ণা নিবারণ করবেন তখন তার যে শান্তি বা স্বস্তি অনুভব হয় তখন এই সেবার দ্বারা আপনার মনে ও এক অফুরান শান্তি বিরাজ করে। তখন শান্তিই হচ্ছে ঈশ্বরের প্রকৃত এক রূপ। যে শান্তি স্বামী বিবেকানন্দ পেয়েছেন বলে লিখেছেন, জীবে প্রেম করে যেই জন, সেজন সেবিছে ঈশ্বর।
জীবে প্রেম করে যেই জন” – আজকের সমাজে এই বাণীর গুরুত্ব
বর্তমান সমাজে যে বিভাজন তৈরি হয়েছে জাতি, বর্ণ, শ্রেণী এবং ধর্ম নিয়ে তা খুবই উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষে মানুষে হানাহানি, মারামারি এবং পদদলিত করার প্রতিযোগিতায় স্বামী বিবেকানন্দের এই বাণী " জীবে প্রেম করে যেই জন, সেজন সেবিছে ঈশ্বর " একটি উদিত সূর্যের আলোর মত ।
প্রতিনিয়ত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও প্রেম ই হচ্ছে আসল ধর্ম। যা সহমর্মিতা, সহযোগিতা এবং মানবিকতার মাধ্যমে আমরা চাইলে বিভেদ কে দূর করে সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারি।
আমাদের এই আত্মকেন্দ্রিক সমাজে শুধুই নিজেকে নিয়ে ভাবা ছাড়া আমাদের আর পরের ভাবনা ভাবার সময় নেই। অসময়ে এবং দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা ভুলেই গেছি। আসলে কি মানবতা ছাড়া সমাজ কখনো উন্নতি হতে পারে?
এমন স্বার্থপরতার দুনিয়ায় জীবের প্রতি ভালোবাসা, দয়া এবং জীবের প্রতি প্রেম এই ভাবগুলি আমাদের বেশি প্রয়োজন । যা দিয়ে আমাদের সমাজের নিপীড়িত এবং শোষিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি।
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেবিছে ঈশ্বর নিয়ে বাস্তব জীবনের কিছু অনুপ্রেরণাদায়ক উদাহরণ
জীবে প্রেম করে যেই জন সেবিছে ঈশ্বর এই আদর্শকে লালন করে জীবন পরিচালনা করেছেনে অনেকে। স্বামীজীর এই বাণীতে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়ার পণ নিয়ে যারা নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তারমধ্যে রয়েছে মাদার তেরেসা হচ্ছে একজন।
যিনি সারা জীবন দরিদ্র, অসহায়, অভিভাবক হীন সন্তানদের ভার গ্রহণ করে সেবা করে গেছেন। আরো রয়েছে সুধামূর্তি যিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সমাজের জন্যে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
বাংলাদেশেও এমন জীবের প্রতি প্রেম নিবেদন করে ঈশ্বর সেবা করছেন অনেক প্রতিষ্ঠানকে আমরা দেখতে পাই। অনেকে আছেন নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষের কল্যাণের জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন। কেউ গোপনে অপ্রকাশিতভাবে সেবা করে যাচ্ছেন এমন সংস্থা ও আমাদের দেশে কম নয়।
তবে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক আমাদের দেশের জন্যে খুবই জনপ্রিয় তারা খুবই প্রেমিক এবং দরিদ্রদের জন্যে খুবই উন্নয়ন মূলক কাজে নিজেদের আবদ্ধ করেছেন। এটা যেন জীব প্রেমের মধ্যে এক অনন্য ঈশ্বর সেবা। এইসব উদাহরণ আমাদের শেখায়, মানবসেবা শুধু একটি কাজ নয়, এটি এক গভীর আধ্যাত্মিক সাধনা।
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেবিছে ঈশ্বর এই নিয়ে শেষ কথা
পরিশেষে বলার যায় যে, স্বামী বিবেকানন্দের এই অমর বাণী "জীবে প্রেম করে যেই জন, সেবিছে ঈশ্বর " এই কথার মানে হলো মানবপ্রেমই শ্রেষ্ঠ সাধনা। ঈশ্বর মন্দির বা উপাসনালয়ে নয় বরং একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে আহার দেওয়া, একজন অসুস্থকে সেবা করা, একজন পথশিশুর মুখে হাসি ফোটানো এটাই প্রকৃত পূজা, প্রকৃত সাধনা।
তাই মানুষকে ভালোবাসুন। শুধু মানুষ বলে কথা নয় সকল জীবকে ভালোবাসুন। আর যদি আমাদের আর্টিকেল ভালো লাগে তাহলে আমাদের কমেন্ট এবং ইমেইল করতে ভুলবেন না। আমরা আছি আপনাদের পাশে বন্ধুরা। ভালো থাকবেন এবং সকল প্রাণীকে ভালোবাসবেন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url